২৬ পৌষ ১৪২৮ মঙ্গলবার ১১ জানুয়ারি ২০২২ এর আনন্দবাজার পত্রিকায় খবরটা পড়ে বুকের মধ্যে কেমন যেন খচখচ করতে লাগলো। শিক্ষা, শিক্ষিত, শিক্ষক, অধ্যাপক ইত্যাদি বিভিন্ন শব্দগুলোর সাথে জড়িত অনুভূতি গুলো সব যেন কেমন বদলে যাচ্ছে। দুমড়েমুচড়ে এমন এক চেহারা নিচ্ছে যে এই শব্দগুলোর সাথে জড়িত চরিত্র এবং ছবিগুলো আমূল বদলে গিয়ে বিকৃত রূপ ধারণ করছে। স্বাভাবিক ভাবেই সামাজিক ধ্যান ধারণা এবং প্রতিক্রিয়াও সম্পূর্ণ আলাদা ভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। আমরা সবাই সবার দিকে পিস্তলের মতো আঙ্গুল উঁচিয়ে নিজেকে নিষ্কলুষ এবং ভাঙ্গন বিরোধী হিসাবে প্রমাণ করতে উদ্যত। কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না।
জানি, বিরক্ত হচ্ছেন। ভাবছেন- ধূর মশাই ! ধান ভাঙতে শিবের গীত। ঝেড়ে কাসুন। যা বলতে চাইছেন বলে আঁতলেমিটা শেষ করুন। আপনাদের কোনো কথা বলা সাজে ? টাকা ছাড়া কিছুইতো বুঝলেন না জীবনে, কী শেখাবেন আমাদের ?
সত্যি বলছি, খুব লজ্জা লাগছে ! বিশ্বাস করুন শেখাবার ধৃষ্টতা বা ঔদ্ধত্য কোনোটাই আমার নেই। নেহাত তুচ্ছ বিষয়ে ‘জোক’ করতে গিয়ে একেবারে জোকার বনে গেলাম মশাই ! সেই গল্পটাই একটু আপনাদের শোনাতে ইচ্ছে হলো। শিক্ষিত তকমাটা গায়ে জড়িয়ে গেছে কিনা, তাই লজ্জা করছে বিষয়টা ব্যক্ত করতে।
এবার শুরু করা যাক- যে যাই বলুক অধ্যাপকদের কাজের চাপ কোনো কালেই ছিল না । যারা দূর দূরান্ত থেকে আসা যাওয়া করেন , কর্মস্থলের আশেপাশে যাদের থাকা পোষায় না তাদের ট্রেনে বাসে যাওয়া আসার ধকলটা একটা চাপের বিষয় বটে। সব রকম কাজের চাপ ধকল কমাতে ‘করোনা অবতার’ ময়দানে অবতীর্ণ হলেন। মানুষজন ঘরে ঢুকে পড়লো। সুতরাং অধ্যাপকদের যেটুকু চাপ ধকল ছিল বিগত দু’বছর ‘করোনা’র দৌলতে সেটাও লাঘব হয়েছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রাতঃভ্রমণ সেরে মজিয়ে এক কাপ চা এবং দুটো ব্রিটানিয়া মারী’র সাথে আনন্দবাজারে চোখ রেখেছি। হেড লাইনগুলোতে চোখ বুলাতে বুলাতে নজরে এলো- ‘আবার শ্রীঘরে এম. এ পাশ চোর ‘। পড়েই নাক সিঁটকে বড় বড় করে চোখ কপালে তুলি। রহস্য উদঘাটনের জন্য ঈষৎ খবরের অন্দরে ঢোকার চেষ্টা করলাম। ও মা ! দেখি ভদ্দরলোক ইংরেজিতে এম. এ, নাম সৌমাল্য চৌধুরী। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, ওর ‘নেশা এবং পেশা দুই-ই হল চুরি। বাবা ছিলেন সরকারি আধিকারিক এবং মা-ও চাকরি করতেন। ছিঃ ছিঃ ! এ হেন বাবা- মা’র সন্তান কিনা শেষে চোর হলো ? আরও একটু ভিতরে ঢুকলাম। যা ভেবেছি তাই ! আমি সামান্য শিক্ষিত, অধ্যাপনা করে পেট চালাই, আমারই লজ্জা লাগছে তো বাবা- মা’র কি মানসিক অবস্থাই না হবে ! ‘ছেলের কুকীর্তি সইতে না পেরে আত্মঘাতী হন মা ‘ । বেচারা ! বেজায় রাগ হচ্ছে ! এমন অকাল কুষ্মাণ্ড সন্তান যে মাতা গর্ভে ধারণ করেছেন তার মানসিক যন্ত্রণা সহজেই অনুমেয়।
মোল্লার দৌড় যেমন মসজিদ পর্যন্ত তেমনি আমার যত রাগ, অভিমান, সমাজ পরিবর্তনের ভালো ভালো ইচ্ছে আমার খুব কাছের এক বন্ধুকেই জানাই। উনি একটু আধটু লেখালেখি করেন। চিন্তা ভাবনা মৌলিক। অদ্ভুত স্বাধীনচেতা মানুষ। কোন কিছুতেই কারো সাথে আপোষ করতে নারাজ। সহজ কথাটা ‘মৃগেন বাবু’র মতো জটিল করে বলতে রাজি নন উনি। সেই কারণেই অনেকে ওনাকে যেমন সমীহ করেন, অনেকেই তেমন কথার মার সহ্য করতে না পেরে কী যেন সব বলে- এখানে বা ওনাকে না বলাই ভালো। আমি মাঝেমাঝে খেই হারিয়ে আমতা আমতা করি, মার না খেলেও ঝাড় খাই বিস্তর, তবু তর্ক করতে ছাড়ি না। আসলে উনি আমার একজন সাহিত্যপ্রেমী বান্ধবী। বন্ধু বলেছিলাম কারণ অনেক কিছুর পরিবর্তনের সাথে সাথে ‘বন্ধু’ বিষয়টা আদি অকৃত্রিম এবং ব্রহ্মার মতো লিঙ্গহীন, এমন এক ধারণার প্রবর্তন হচ্ছে আজকাল। ফোন লাগাই —
–কী করছো ?
–সকালেই ? কী ব্যাপার ?
–এই চা খেতে খেতে ভাবলাম একটু ফোন করি
–আমিও চা এবং খবরের কাগজ নিয়ে বসেছি। এই সময়টা আমি উপভোগ করি। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কাগজটা পড়ি ।
–এম. এ পাশ চোরের খবরটা পড়লে ? ছিঃ ছিঃ !
–ছিঃ ছিঃ কেন ? সৌমাল্য আমার কাছে হিরো। রবিন হুড। একজন বিপ্লবী, এই আপাদমস্তক দুর্নীতিতে ডুবে থাকা সমাজের বিরুদ্ধে ও হচ্ছে এক জ্বলন্ত প্রতিবাদ —
এবার আমার হোঁচট খাওয়ার পালা। বললাম-
–কী বলছো এসব ? একজন চোর– —
–চোর ? তুমি চোর নও ?
বুকে একটা আলপিন ফুটে গেল মনে হলো! আমতা আমতা করতে লাগলাম–
— কি- কি বলছো ? আ…আমি চোর ?
–নয় ? মাসে কটা ক্লাস নাও ? কত মাইনে পাও হিসাব করেছো কোনো দিন ? বিগত দু’বছরে তো সম্পূর্ণ বসে বসে লক্ষ লক্ষ টাকা ঘরে তুলেছো, কী তোলোনি ?
অস্বীকার করবো এ সাধ্য আমার কোথায় ? তবু আত্মরক্ষার তাগিদে বললাম —
–এটাকে চুরি বলবে ?
–নয়তো কী ? তোমরা সময় এবং সুযোগ কাজে লাগিয়ে চুরি করছো না ? ছাত্র ছাত্রীদের ক্লাস নেওয়ার যথাযোগ্য উদ্যোগ নিয়েছো কোনদিন ? অন লাইন ক্লাস ঠিকঠাক করো ? নিজেদের বুকে হাত রেখে নিজেদের প্রশ্ন করো। কত স্কুল শিক্ষক শিক্ষিকাদের দেখেছি ক্লাস চুরি করে প্রাইভেট টিউশনি করছে। এটা চুরি বলবে না ? ডাক্তার সরকারি হাসপাতাল থেকে সময় চুরি করে প্রাইভেট চেম্বারে রুগী দেখছেন, নার্সিং হোমে যাচ্ছেন। এসব চুরি নয় ?
আমি বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। কি বলবো বুঝে উঠতে পারছিনা। মনে হচ্ছে আমি সৌমাল্য এর থেকে কম অপরাধী নই! বন্ধু রাগে গজগজ করেই চলেছে–
–রাজনৈতিক দালাল এবং গুন্ডার দল সাধারণ মানুষের পকেট কেটে নেতাদের পকেটে গুঁজে দিয়ে আসছেন। নদীর বালি চুরি, মাটি চুরি, আস্ত পুকুর, নদী ভরাট হয়ে গিয়ে প্রভাবশালীদের বাড়ি হয়ে যাচ্ছে। এগুলো কী ? চুরি বলবে না ?
মাথা ঘুরছে। অপমানিত বোধ করছি তবু তর্ক করার মতো যুতসই কোন যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি না। বলি–
— ঠিক আছে , ছাড়ো —
দপ্ করে জ্বলে উঠলো আমার বান্ধবী —
–নিতে পারছো না, তাইতো ? আসলে শুধু প্রতিবাদ নয়; বোধশক্তি হারিয়েছি আমরা । আমার কাছে সৌমাল্য একটা প্রতিবাদ ।
–চুরির প্রতিবাদ চুরি ?
–নয় কেন ? কিছুদিন আগে একদল মেয়ে নগ্ন হয়ে রাস্তায় মিছিল করেছিল। সামনে ফেস্টুনে লেখা ‘Rape me’। শিক্ষিত ছেলেদের ভবিষ্যৎ চুরি করে চাকরি দালালদের হাতে বিক্রি হচ্ছে। আর তো কোন উপায় নেই বন্ধু।
এবার আমার অবস্থা সত্যি কাহিল। মনে হচ্ছে এমনটাই করা উচিত। দিশাহীন এই দেশে, এই পৃথিবীতে আর কি-বা করার আছে শিক্ষিত যুবক যুবতীদের। চুরিই যেখানে সবকিছুর একমাত্র অন্তর্নিহিত চালিকা শক্তি সেখানে চুরি পেশা হলে দোষ কোথায় ? ধন্য সৌমাল্য !